বর্তমানে দেশের
অন্যতম আলোচিত ঘটনা হচ্ছে ‘আনুশকা হত্যা’ । মতের পিঠে মত। কেউ পজিটিভ তো কেউ
নেগেটিভ। কেউ ছেলেটিকে ধর্ষক বলছে আর কেউ বলছে মেয়েটিরও দোষ কোনো অংশে কম নয়।
সবকিছু মিলিয়ে এটিই সত্যি, গঠনমূলক চিন্তা বা কথা বলার মানুষ নেই, এই ব্যাপারে
যৌনতাকে ফোকাস করে মজা লুটে নেওয়ার মানুষই বেশি। ধর্ষনের কথা বলি কিংবা কিশোর
বয়সের অতি উৎসাহবশতঃ করা দুর্ঘটনা বলি
দুইক্ষেত্রেই একটাই সমস্যা। তা হল – সঠিক যৌনশিক্ষার অভাব।
যৌনতা হল পৃথিবীর
প্রত্যেকটা প্রানী ও মানুষের জৈবিক চাহিদার নাম। মানুষ হোক বা প্রানী , খাদ্যগ্রহণ
ও শারীরিক চাহিদায় যৌনাচারণ এ দুটো কখনো কাউকে শিক্ষা দিতে হয়না। আমাদের দেশে
নারীদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নিয়েও মানুষ খারাপভাবে আলোচনা করে। রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া
কিশোরী-তরুনী-নারীদের উদ্দেশ্য করে নানা রকম বাজে মন্তব্য ছুড়ে দেওয়া যেনো খুবই
সাধারণ একটি বিষয়। নারীদের ঋতুস্রাবকেও ট্যাবু হিসেবে দেখা হয় আমাদের দেশে। এইসবকিছুর
মূলে রয়েছে আমাদের কিছু প্রথাগত বিশ্বাস।
আমাদের দেশে
অপরাধের প্যাটার্ণ হল একবার যা সংঘটিত হয় এরপর বেশ কিছুদিন তা ট্রেন্ডের মত হয়ে
সংঘটিত হতে থাকে। যেমন – খুন, ধর্ষন, গুম, কিডন্যাপ ইত্যাদি অপরাধমূলক ঘটনা যদি
একবার সংঘটিত হয় তাহলে তা একনাগাড়ে বেশ কয়েকবার ঘটতে থাকে। বেশ কিছু গণমাধ্যম ও
অনলাইন পোর্টাল আছে যারা এসব ঘটনাকে রসালো করে সবার সামনে প্রকাশ করে। ধর্ষনের নিউজের
ক্ষেত্রে আসল ঘটনার সাথে আরো অনেক বাড়তি কথা যোগ করে সবার কাছে মুখরোচক আলোচনার বিষয় করে তুলে।অথচ একবারো
ভাবেনা ধর্ষিতা মেয়েটির সম্মানের কি হবে। একজন মেয়ে বা নারীকে ধর্ষন করার পর সবাই
সমাজের, পরিবারের কলঙ্ক নিয়ে চিন্তা করে। কিন্তু কেউ সেই মেয়েটিকে নিয়ে
ভাবেনা।আমরা এই সামান্য বিষয়টি মাথায় রাখিনা যে মেয়েটি কতটা দূর্বিষহ সময় পার করে।
ধর্ষিত হয় নারী, শারীরিকভাবে অত্যাচারিত হয় নারী, সবার কাছে সমালোচনার শিকার হয়
নারী, দোষ দেওয়া হয় নারীকেই এবং অবশেষে আত্মহত্যার পথও বেছে নেয় নারী। অথচ সেই
ধর্ষকের যেনো কোনো ভুলই থাকেনা।আইনও একসময় নিরব দর্শক হয়ে যায় যেন! এভাবে চলতে
থাকলে একসময় দেশের পরিস্থিতি কতটা খারাপ হয়ে যাবে তা কি কল্পনা করতে পারেন?
যৌনশিক্ষা শুরু
হতে হবে পরিবার থেকেই। কিছু চিত্র আমাদের খুবই পরিচিত।মনে করুন, একটি পরিবারে
ভাই-বোন দুজন আছে। অথচ একই ছাদের নিচে বছরের পর বছর বাস করার পরেও দুজনের মধ্যে
আড়াল থেকেই যায়। বয়ঃসন্ধির সময়টাতে মা-বাবা আকারে ইংগিতে বুঝিয়ে দেন তোমার ভাই বা
বোনের সাথে তোমার একটা দূরত্ব তৈরী করার সময় হয়েছে। অথচ এই সময়টাতেই মা-বাবার দুই
সন্তানকে আরো বেশি কাছে রাখা উচিত। পরিচয় করানো উচিত সেই অদৃশ্য দেয়ালের সাথে।
একটি মেয়ের বয়ঃসন্ধির সময়টাতে ঋতুস্রাব হয়। পরবর্তী জীবনের একটি নির্দিষ্ট সময়
পর্যন্ত এই শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া নারীদের চলতে থাকে।খাওয়া, ঘুমানো, মাথাব্যাথা,
পেটব্যাথার মতই খুব সাধারণ একটি বিষয় মেয়েদের পিরিয়ড বা মাসিক হওয়া। অথচ এই সাধারণ
ব্যাপারটিকে সবার জানাশোনার আড়ালে রাখতে পারলেই যেনো বেঁচে যায় মেয়েরা। এই
সময়টাতেই মা এবং বাবা দুজনকেই ছেলে মেয়ের বন্ধু হয়ে উঠতে হয়। ভবিষ্যতে আপনার
সন্তানকে সুস্থ মন মানসিকতাসম্পন্নভাবে গড়ে তুলতে তাদের জানার আগ্রহকে প্রাধান্য
দিন বেশি। আপনার ছেলে সন্তানকে জানান তার মা, বোন, বান্ধবীসহ পৃথিবীর প্রত্যেকটি
মেয়েই প্রতিমাসে একটি শারিরীক যন্ত্রনার মধ্যে দিয়ে যায়। এই সময়টাতে তার উচিত তার
মা,বোন কিংবা বান্ধবীর প্রতি সহানুভুতিশীল হওয়া এবং এটি কোনো অতিরিক্ত আগ্রহ বা
উপভোগ করার মত বিষয় নয়। এই বিষয়টি আপনার ছেলে সন্তানকে যত সহজভাবে বুঝিয়ে দিতে
পারবেন তার মনে তত দ্রুত নারীদের প্রতি ভালো মনোভাব তৈরী হবে যা আজীবন থাকবে। কারণ
একজন সন্তান কতটা ভালো মানুষ হয়ে গড়ে উঠে তা তার মা-বাবার শিক্ষার উপর অনেকটুকু
নির্ভর করে। পশ্চিমা দেশে প্রকাশ্যে চুমু খাওয়াকে বৈধতা দেয়া হয় আর আমাদের দেশে
লজ্জার ব্যাপার। অথচ প্রতিটা উঠতি বয়সী ছেলেমেয়েরাই আগ্রহ থেকে হোক বা সঙ্গদোষে
হোক পর্ণ সাইটগুলোতে ঢু মারে । অনেক মা বাবা এমনও আছেন যারা সন্তানের সামনে
নিজেদের খুব বেশি সংযত করে চলেন, কথা বলেন খুব কম। নিজেদের মধ্যে যে একটা ভালো
সম্পর্ক আছে তা ছেলেমেয়ের সামনে প্রকাশ করেন না। এক কথায় আমরা বুঝি, ‘কনজারভেটিভ
ফ্যামিলি’। অনেকে ধর্মের দোহাই দিয়ে, ভদ্রতার লেভেল লাগিয়ে এমন পরিবার গঠন বা
পছন্দ করে থাকতে পারেন হয়তো। অথচ জরিপ করলে দেখা যাবে এসব পরিবারের ছেলেমেয়েরাই
নষ্ট হয় আগে। আপনি আপনার বাসার ভেতরের পরিবেশকে কন্ট্রোল করতে পারেন, বাইরের
দুনিয়াটাকে নয়। তাই আপনার সন্তান বাইরে থেকে খারাপ শিখে আসার আগে তাকে সত্যটা
জানিয়ে ভালো করে গড়ে তুলুন।সে সত্যটা জানুক, শিখুক। সে বুঝুক চুমু খাওয়া, কাউকে
জড়িয়ে ধরা কিংবা ‘আই লাভ ইউ’ বলাটা কখনোই সংস্কৃতিপরিপন্থী নয় । এসবে কখনো একজন
মানুষের যৌন লালসা তৈরী হয়না। যৌনতা কখনোই লালসা নয়, এটা একটা শারিরীক চাহিদা যেমন
ক্ষুধা লাগলে আমরা খাই টিক সেরকম। তবে পার্থক্য এটুকু আপনার যখন খিদে লাগবে আপনি
তখন যা ইচ্ছা খেতে পারেন ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য। কিন্তু যৌনতা যখন তখন যেখানে
সেখানে যার তার সাথে মেটানো যায়না। আপনার সন্তানের বায়না পূরণ করতে তার হাতেই অল্প
বয়সেই মোবাইলে মত যন্ত্র সাথে ইন্টারনেট সুবিধাগুলোও দিয়ে দিচ্ছেন। কখনো কি চিন্তা
করে দেখেছেন আপনার সন্তান সেই বায়নাকে কিভাবে উপভোগ করে? না করেন না। আপনার
সন্তানকে মোবাইল ব্যবহার করতে দিন, ইন্টারনেট সুবিধাও দিন কিন্তু তার সঠিক
ব্যবহারটা শেখান। তাঁকে বহির্বিশ্বের সাথে পরিচয় করান। ইউটিউবে নানারকম উদ্ভাবনি
বিষয়গুলোকে শেখান। তাকেও উদ্যোগী করে তুলুন। দেখবেন, আপনার সন্তান ভালোটাই শিখবে।বিয়ে
করা নিয়ে যে আমাদের দেশের কিছু ধারাবাহিকতা আছে তা থেকে বের করে আনুন। বিয়ের মতো
একটি পবিত্র সম্পর্ককেও অনেকে যৌনতার লাইসেন্স বলে চালিয়ে দেন। আপনার সন্তানকে এসব
তথাকথিত চিন্তাপ্রবাহ থেকে বের করে এনে আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারেন আপনি।
তাই যৌনশিক্ষার শুরুটা হোক পরিবারের ছত্রছায়া থেকে।
যৌনশিক্ষা বললেই
আমাদের দেশের মানুষ মনে করে যৌনসঙ্গম করার প্রক্রিয়াই বুঝি শেখানো হয়। না, এটি
সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। যৌনশিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হল ছেলে-মেয়েদের মধ্যে বিপরীত
লিঙ্গকে নিয়ে যে একটা অবোধ্য চিন্তা –আগ্রহ থাকে তাকে সঠিক উপায়ে বিশ্লেষন করে
দেয়া। যাতে করে ছেলে বা মেয়ে কেউই ভুল কোনো সিদ্ধান্তের দিকে পা না বাড়ায়।
প্রানীরাও কিন্তু মানুষের মত যৌনাচরন করে। কিন্তু কখনো কি দেখা গেছে এক প্রানী
অন্য প্রানীকে বা দুটো একই প্রজাতির প্রানীর মধ্যে কোনো যৌন সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে?
না। অথচ আমরা পৃথিবীতে সৃষ্টির সেরা জীব হয়েও বিকৃত যৌনলালসার শিকার নারীদের গল্প
তৈরী করি। ২০১০ সালের শিক্ষানীতিমালা অনুসারে আমাদের দেশে ষষ্ট শ্রেনী হতে শুরু
করে “স্বাস্থ্য শিক্ষা” নামে একটা পাঠ্যবই
অন্তর্ভূক্ত করা হয়। এখানে যৌনতা নিয়ে প্রাথমিক ধারনা দেওয়া হয় । এ নিয়ে যে ভ্রান্ত
ধারনা আছে তা দূর করা , সম্মতি নিয়ে ও সম্মতি ছাড়া যৌন সম্পর্ক স্থাপন করার মধ্যে যে
বিশাল পার্থক্য আছে তা বয়ঃসন্ধির সময়টাতেই ছেলেমেয়েদের জানানোর জন্য পড়ানো হয়। নিরাপদ
থাকার জন্য মেয়েদের করনীয় ও মনে রাখার বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়।
আমাদের দেশের
সবচেয়ে নাজুক বিষয় হলো – ধর্মানুভূতি।কিন্ত যৌনশিক্ষার কথা বলাকে ধর্মানুভূতিতে
আঘাত করার তকমা লাগানো হয়। তারা মনে করে যৌনশিক্ষার নামে হয়তো স্কুলের কোমলমতি ছেলেমেয়েদেরকে
পশ্চিমা দেশের সংস্কৃতি শেখানো হয়। বাস্তবিক পক্ষে তেমনটা মোটেও নয়। অথচ ধর্মের
সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই।প্রতিদিন যে হারে ধর্ষন ও ইভটিজিং এর মতো ঘটনা বেড়ে
চলেছে আমাদের দেশে তার জন্য স্কুলপর্যায়ে যৌনশিক্ষার মতো পদক্ষেপকে জোড়ালোভাবে প্রতিষ্ঠিত
করা উচিত। সামাজিক মূল্যবোধ দিন দিন শূন্যের কোঠায় পোঁছে যাওয়ায় এই ধরনের অপরাধ বেড়ে
চলেছে। সামাজিক মূল্যবোধ সৃষ্টিতে পরিবারের কোনো বিকল্প নাই। তাই আর আড়ালে থাকা নয়
, যৌনশিক্ষা ভেঙ্গে ফেলুক সমাজের অযাচিত ট্যাবুগুলোকে।