তাঁতের শাড়ি ও বাঙ্গালী নারী!

তাঁতের শাড়ি ও বাঙ্গালী নারী!

Clothing, Health and Beauty

"শাড়িতে নারী" বাক্যটি একজন বাঙ্গালী নারীকেই যেনো বিশ্লেষন করে দেয়। এক সময় বাঙ্গালী নারীর প্রধান বস্ত্র ছিলো হাতে বোনা তাঁতের শাড়ি। 

 

বাংলা তথা ভারতীয় উপমহাদেশের অনেক প্রত্নতাত্বিক নিদর্শন প্রমাণ করে বাংলায় তাঁতের শাড়ির চাহিদা প্রচলন কতোটা জনপ্রিয় ছিলো। লোকমুখে শোনা যায় যে  বাংলাদেশের টাঙ্গাইল অঞ্চল ছিলো তাতেঁর শাড়ির জন্মস্থান আর অঞ্চলের 'বসাক' সম্প্রদায় এর তাঁতীরাই আদি তাঁতী হিসেবে পরিচিত ছিল। 

 টাঙ্গাইলের বিভিন্ন বাজার থেকে সংগ্রহকৃত তাঁতের শাড়ি তৎকালীন উপমহাদেশের বড় বাজার কলকাতা হয়ে পৌঁছে যেত পশ্চিমবঙ্গের ব্যবসায়ীদের হাতে।  আর এভাবেই ভারতীয় উপমহাদেশে তাঁতের শড়ির জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। তবে ইতিহাস মতে মোগলরা তাঁতের শাড়ির উন্নতিতে পৃষ্ঠপোষক হিসেবে বেশ ভালো ভূমিকা পালন করেছিলো। 

 

তাঁত শব্দটি এসেছে সংস্কৃত শব্দ "তন্তু" থেকে। তৎকালীন সময়ে সাধারন বাঁশ, কাঠ এগুলো দিয়ে তৈরী করা হত তাঁত মেশিন। প্রাকৃতিক উপাদান তুলা থেকে আঁশ বা তন্তু আলাদা করে তা সুতায় রুপান্তরিত করা হত।আর সেই সুতা দিয়ে ঘরে তৈরি মেশিনে বোনা হত তাঁতের শাড়ি। 

সুতা রঙ করা,ওয়ার্পিং করা এবং এদেরকে উপযোগী আকার দেওয়া সব তাঁতীরা হাতেই করে থাকেন কোনো ধরনের প্রযুক্তির ছোঁয়া ছাড়া।  বর্তমানে প্রচলিত তাঁত মেশিনের প্রকারভেদ আছে বিভিন্নরকম। পিটলুম বা গর্ত তাঁত, ফ্রেমলুম, কোমর তাঁত, চিত্তরঞ্জন বা জাপানী তাঁত ইত্যাদি তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। 'পিটলুম'কে আদি তাঁত বলা হয় এর প্রাচীনতার প্রেক্ষিতে।আর তাছাড়াও তৎকালীন সময়ের জনপ্রিয় জামদানী শাড়ি তৈরী হত পিটলুম তাঁতে। ইদানীং কালে 'পাওয়ারলুম' এর ব্যবহার বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে।

 

বুনন কৌশল কাপড়ের সূক্ষ্মতা সবদিক বিবেচনা করে কোনো শাড়িতে একদিন, কোনো শাড়িতে দুইদিন এমনকি কাজের ভিত্তিতে এক মাস পর্যন্ত সময় লাগতে পারে বুনন শ্রমিকদের। বুনটের পাশাপাশি শাড়ির  নকশাও বেশ আকর্ষণীয় হয়। বিভিন্ন ধরনের জ্যামিতিক আকৃতি, ফুল,পাখি, লতাপাতা, ময়ূর, কিংবা গ্রামীন জীবনধারাও কিছু কিছু কাপড়ের ডিজাইন হয়।

 

জামদানি, বালুচরি, সফট সিল্ক, হাফসিল্ক, হাজারবুটি, থান, বেনারসি, সুতি পাড়, কটকি, স্বর্ণচুর, আনারকলি, দেবদাস, কুমকুম, প্রভৃতি সাধারণ নামের শাড়ি টাঙ্গাইলের বিভিন্ন ফ্যাক্টরীতে  তৈরী হয়। তাঁতের কাপড় নিয়ে বলতে গেলেই একটি নাম চলে আসে তা হলো 'ঢাকাই' শাড়ি। মিহি সুতার কাজ বুননকৌশলের দক্ষতার জন্য ঢাকাই শাড়ির খ্যাতি আজও অমলিন। জামদানী এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও বাংলাদেশের নকশার কারণে খ্যাত আরেকটি নকশা হলো  'বেনারসি' বা ঢাকাই কাতান।আমাদের দেশের আরেকটি বিখ্যাত তাঁতের শাড়ি হলো 'পাবনা শাড়ি' এটি পাবনা-সিরাজগঞ্জ অঞ্চলে শাড়ি বুনতো মুসলমান তাঁতীরা। টাঙ্গাইল শাড়ির তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম ডিজাইন হওয়ায় দামও কম। কারণে নিম্নবিত্ত নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের নারীদের মধ্যে শাড়ির জনপ্রিয়তা বেশি।

 পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে বিশেষ ধরনের নকশাখচিত তাঁতের শাড়ির উদ্ভব হয় আঠারো শতকের শেষার্ধে। এর নাম ছিল 'বালুচরি' যদিওবা বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভের দিকে শাড়ী বিলুপ্ত হয়ে যায়। কিন্তু তাঁতের কাপড়ে বিশেষ ধরনের নকশার কাজ করতে পারাটা যেখানে সহজ ছিলোনা সেখানে বালুচরি-শাড়ির মতো নকশাসম্পন্ন রেশমি কাপড় বেশ ভালই জনপ্রিয়তা পেয়েছিলো।এখন জ্যাকার্ড মেশিনে তৈরী হয় 'বালুচরি' শাড়ি।

 ডিজাইন, বুনন, দাম সবদিক থেকে টাঙ্গাইল এর তাঁতের শাড়ি সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। শাড়ির বিভিন্ন নাম মানের কারণে বিভিন্ন রকম দাম হয়ে থাকে।

 

বর্তমানে প্রযুক্তির অগ্রগামীতার কারনে তাঁতীরা আগের মতো আর ঘরে বসে তাঁত মেশিনে কাপড় বোনেননা। জীবনযাত্রার তাগিদে অনেকে শহরাঞ্চলে পাড়ি জমান। তবে আশার ব্যাপার হলো বিভিন্ন কুঠির শিল্প ফ্যাশন হাউসগুলো এখন দিন দিন তাঁতের কাপোরের উপর জোর দিচ্ছে। ক্রেতাদের কাছে তুলে ধরছে আমাদের বাঙ্গালীর অন্যতম ঐতিহ্য তাঁতের কাপড়ের বিশেষত্ব পহেলা বৈশাখ বা বিভিন্ন পূজা পার্বনে কিংবা যেকোনো বিশেষ আয়োজনে নারীরা এখন তাঁতের শাড়ির উপরে ঝুঁকছে দিন দিন। আর এর কৃতিত্ব যায় নগরীর ফ্যাশন হাউসগুলোর পক্ষে। আরো উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, বর্তমান সময়ের জনপ্রিয় বিষয় হল অনলাইন ব্যবসা। ঘরে বসে ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে সরাসরি সম্পর্ক হওয়ার মাধ্যম হলো অনলাইন এখন অনলাইন ব্যবসায়ীরাও দেশী পণ্য হিসেবে তাঁতের কাপড়ের উপরো বেশ জোর দিচ্ছেন। আগামী দিনগুলোতে আমাদের দেশীয় পণ্যের জন্য যা শুভ দিক হিসেবে গণ্য হবে।

 

একজন বাঙ্গালী নারীর নিত্য পরিধেয় পছন্দের পোশাকের তালিকায় তাঁত জাতীয় কাপড়,শাড়ি এসব পোশাক থাকাটা আবশ্যক। নিজ দেশের পণ্যের ব্যবহার বৃদ্ধি  পেলে তা আমাদের দেশীয় পোশাক খাতকে বিশ্বে পরিচিত করতে সাহায্য করবে। তাই কাপড়ের নমনীয়তা, নকশা , বুনন ইত্যাদি দিক বিবেচনা করে তাঁত পণ্যকে অগ্রাধিকার দিন। অন্য পোশাকের সাথে তাঁত শাড়িকেও প্রাধান্য দিন। 

Osellers  পাচ্ছেন নিত্য নতুন ডিজাইন নানা রঙের তাঁতের শাড়ি