সামিহা – একটি সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানীতে প্রজেক্ট ম্যানেজার পদে চাকরী করেন। কয়েক মাস হলো তিনি মা হয়েছেন। সারাদিন অফিসের নানা কাজের সাথে সাথে তাল মিলিয়ে চলে বাসায় রেখে আসা সন্তানের খোঁজ খবর নেয়া। তাঁর টীমে পাঁচজন কাজ করে। প্রত্যেকেই কাজের ব্যাপারে খুব ডেডিকেটেড।
আজ একটা প্রজেক্ট প্রেজেন্টেশন আছে সকাল ১০টায়। ঘড়িতে ৯টা ৫০ বাজে। অথচ সামিহা এখনো জ্যামে আটকে। বাচ্চাটার আজকে টিকা দেয়ার ডেট ছিলো। ওদিকটা সামলে আসতেই মূলত দেরীটা হলো। কোনোরকমে অফিসে ঢুকেই সোজা কনফারেন্স রুমে গিয়ে দেখে শাহাদাত প্রেজেন্টেশন এগিয়ে নিয়েছে অনেকটুকু। সামিহা বসকে দেরীর জন্য ক্ষমা চেয়ে কথা বলতে চেষ্টা করলেও তিনি ইশারায় তাঁকে চুপ করিয়ে দিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত ক্লায়েন্ট প্রেজেন্টেশনে খুশী হয়ে তাদেরকেই কাজটা দিলেন। বস ফরিদ সাহেব সামিহাকে অভিনন্দন জানালেন সাথে তার টীম ওয়ার্কেরও প্রশংসা করলেন। কিন্তু তবু সামিহার মন খারাপ। নিজের জীবনের বদলে যাওয়াটাতেই যেন কষ্ট পাচ্ছে। তার নিজেরই মনে হচ্ছে সে কোম্পানীকে কিছু দিতে পারছেনা। এসব ভাবতেই তার কষ্ট আরো বেড়ে যায়। এমন সময় রুমে চা নিয়ে আসা পিয়নের সাথেও উঁচু গলায় কথা বলে ফেলে সামিহা। পরক্ষনে নিজেই ভুল বুঝে কান্না লুকোয়। শাহাদাত এসে জানায়, “ম্যাম, আমাদের একটা ডিসিকাশনে বসার কথা ছিলো”। সব চিন্তা এক পাশে রেখে টীম নিয়ে ডিসকাশনে বসে সে।
প্রজেক্ট এর এক একটা অংশের ভার পাঁচজনের মধ্যে ভাগ করে দিয়ে সম্পূর্ণ কাজটা আলোচনা চলছে এমন সময় বাসা থেকে ফোন আসতে থাকে। এক বার দু বার করে কয়েকবার ফোন কাটলেও অবশেষে উতলা হয়েই ফোনটা তুললো সামিহা। বাচ্চাকে নিয়েই টেনশনটা বেশি কাজ করে। আবার নিজেকে অপরাধী মনে করতে থাকে সে। কোনো দিকই যেন সে সামলাতে পারছেনা।
সন্ধ্যা প্রায় ৭:৩০ টা বাজে ঘড়িতে। এখনো নিজের কাজ শেষ করতে পারেনি। তার উপর টীমের ছেলে মেয়েগুলোও যথেষ্ট কাজ করছে এখনো অব্দি। তাদের সাথে কাজ নিয়ে কথা বলতে গেলে তারাই সামিহাকে বললো,” ম্যাম আপনি বাসায় চলে যান। কাজটা আমরা শেষ করে ফেলতে পারবো”। সামিহার কষ্টটা আরো বেড়ে গেলো। একটা সময় সে নিজেই এদের কাজের জন্য আটকে রেখে প্রজেক্ট নিয়ে নির্দেশনা দিতো। আজকে তাদেরই তাঁকে দরকার হচ্ছেনা।
বের হতে হতে আবার থমকে গিয়ে টীমের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। ছেলেমেয়েগুলো কাজ বন্ধ করে সামিহার দিকে তাকিয়ে রইলো। সামিহা বললো, “ তোমাদের আমার আর দরকার নেই তাইনা? আমি আর আগের মতো তোমাদের ভালো ইন্সট্রাকশন দিতে পারিনা। আমার কারণে তোমাদের কাজের অগ্রগতি হয়না। “ এই বলে সামিহা কাঁদতে লাগলো। শাহাদাত , অদিতি, সৌরভ, ইমরান, তৃষা সবাই একসাথেই বলে উঠলো, “এমনটা নয় ম্যাম। আপনি সবসময়ই আমাদের উৎসাহ দিয়েছেন। আপনার পরামর্শের কারণেই আমরা কাজ ঠিকমতো শেষ করতে পারছি এখনো। আপনি আমাদের আদর্শ।“ ওদের কথাগুলো শুনে সামিহা আরো কাঁদতে লাগলো। অদিতি বললো,”ম্যাম আপনার এখন বেবির কাছে যাওয়া উচিত।কাল সকালেই প্রজেক্ট রেডি পাবেন।“ ইমরান বলে উঠলো,” ম্যাম ১০ টার আগেই মেইল করে দেবো।“ সবাই একসাথেই হেসে সায় দিলো। সামিহা আর না হেসে পারলোনা। ভেজা চোখেই হাসি দিয়ে ছেলেমেয়েগুলোকে “শুভরাত্রি” বলে সামনের দিকে এগিয়ে গেলো । হঠাৎ করেই সবকিছু যেনো হালকা মনে হচ্ছে। নিজের মধ্যে আর অপরাধবোধ কাজ করছেনা।
হ্যাঁ, এমনটাই হয়। মা হওয়ার পর ক্যারিয়ার ধরে রাখাটাই নারীদের জন্য চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়ায়। অনেক নারীরাই সন্তান-সংসার আর ক্যারিয়ারের মাঝে নিজেকেই হারিয়ে ফেলে। শেষ পর্যন্ত ক্যারিয়ারকে বিসর্জন দেন বেশিরভাগ নারীরা। এর মূল একটি কারণ হল কর্মক্ষেত্রে সহযোগীতার অভাব। আর সাথে থাকে পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন (Postpartum Depression) . উপরের গল্পের সামিহার মন খারাপ হওয়াটাও পোস্টপার্টামের অংশ।
পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন কোনো রোগ নয়। দশটা মাস সন্তানকে নিজের মধ্যে ধারণ করা, তার জন্মের জন্য অপেক্ষা করা – এগুলো সবই একজন গর্ভবতী নারীর জন্য মানসিক চাপ। যা সন্তান জন্মদানের পরও কিছুটা থেকে যায়। সন্তান জন্মের পর দেখা যায় – কোনো কারণ ছাড়াই কান্না পায়, বেশি মানুষজন বা ভীড় দেখলে বিরক্ত লাগে, সবসময় অস্থিরভাব কাজ করে, মাথা খিটখিটে হয়ে যায়, নিজের শারীরিক পরিবর্তন নিয়ে হীনম্মন্যতা তৈরী হয় ইত্যাদি। সন্তান প্রসবের পর প্রায় ৭০-৮০% নারীদের এই সমস্যা হতে দেখা যায়। এ সমস্যা সন্তান জন্মের দুই-তিনদিন পর থেকে শুরু করে পরবর্তী দুই-তিন সপ্তাহ পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। এটিকে ডাক্তারী ভাষায় বেবি ব্লুস (baby blues) বলে। বেবি ব্লুস বেশিদিন স্থায়ী হলে তাকে পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন বলে।
কর্মজীবি নারীদের ক্ষেত্রে যারা সন্তান জন্ম দিয়েই আবার কাজে যোগ দেন তাদের জন্য ব্যাপারটা আরো কঠিন হয়ে পড়ে যখন সহকর্মী ও অফিসের সবাই তাঁকে সাহায্য করেন না। পরিস্থিতিকে সহজ করে তোলাটা যেখানে আমাদের দায়িত্ব সেখানে আমরা ব্যাপারগুলোকে দেখেও না দেখার ভান করি। পশ্চিমা দেশগুলোতে এসব ব্যাপারে সচেতনতা এসেছে অনেক আগেই। আমাদের দেশেও এ ব্যাপারগুলো নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করাটা জরুরী। কে কখন সচেতন হবে তার অপেক্ষা না করে আসুন নিজের অবস্থান থেকে নিজেই সোচ্চার হই আগে। আপনার সহকর্মী যদি নতুন মা হন তবে তাকে কিছুদিন কাজের ক্ষেত্রে সাপোর্ট দিন। নিজের কাজের ফাঁকে ফাঁকে তার ভাল-মন্দের খোঁজ নিন। কোনো সমস্যায় পড়লে তাঁকে নিজের সাধ্যমত উপদেশ বা সাজেশন দিয়ে এগিয়ে দিন। এটা শুধু সদ্য মা হওয়া সহকর্মীর ক্ষেত্রেই নয়। যদি আপনার সদ্য বাবা হওয়া সহকর্মীর মধ্যেও আপনি মানসিক চাপ বা ডিপ্রেশন খেয়াল করে থাকেন তবে একজন সচেতন মানুষ হিসেবে তাকেও নিজের অবস্থান থেকে মেন্টাল সাপোর্ট দিন।
উপরের গল্পে সামিহার সহকর্মীরাই এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ। যারা নিজেদের মধ্যে কাজের বন্টন করে নিয়ে এবং নানাভাবে সাহায্য করে সামিহাকে এটাই বুঝিয়ে দিয়েছে সে একা নয়। একই সাথে ক্যারিয়ার ও সন্তান পালন দুটোর এক যুদ্ধে তারাও সামিহার পাশে আছে বন্ধু হয়ে। আসুন নিজে জানি, অপরকেও জানাই। এমন অনেক গল্প অনেক সামিহার ক্যারিয়ারকে বাঁচাতে পারে যদি পাশে থাকে সচেতন সহকর্মী ও পজিটিভ কাজের পরিবেশ।