ঋতুস্রাব – মেয়েদের
জীবনে অতি পরিচিত অথচ লুকিয়ে রাখার মতো একটা শারীরিক প্রক্রিয়া। বয়ঃসন্ধির
সময়টাতেই মেয়েদেরকে এই শব্দটির সাথে পরিচিত হতে হয়। এটি একটি স্বাভাবিক শারীরিক
প্রক্রিয়া, কোনো রোগ নয়। প্রতিটা নারীর জীবনচক্রেরই অংশ পিরিয়ড বা মাসিক বা
ঋতুস্রাব। অথচ এটি নিয়ে আছে নানারকম কুসংস্কার। মেয়েদের পেরোতে হয় নানা
বাঁধাবিঘ্ন।
মাসিক কেন হয়?
মাসিক শব্দটির
সাথে পরিচিত হওয়ার পর থেকেই প্রতিটি মেয়ের মনে প্রশ্ন জাগে , মাসিক কেন হয়?আধুনিককালে
এই প্রশ্নটি মনে আসা বেশ স্বাভাবিক। আর এ
প্রক্রিয়া সম্পর্কে মেয়েদের জানা উচিত কারণ এটি একটি প্রাকৃতিক পদ্ধতি এবং এর মধ্য
দিয়েই তাঁকে যেতে হয়। বয়স যখন ১০-১২ হয় তখন মেয়েদের শরীরে পরিবর্তন আসে। আস্তে
আস্তে তার নানা রকম শারীরিক পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। উচ্চতা বৃদ্ধি
হয়। স্তন বড় হয়। উরু আর নিতম্ব ভারী হয়। কোমর সরু হয়ে উঠে। ডিম্বাশয় ও জরায়ুর
বৃদ্ধি হয়। পরিপক্কতা আসে সারা শরীরে। কিশোরী বয়সে হঠাৎ এমন দৈহিক পরিবর্তন প্রভাব
ফেলে মানসিকতায়। আর তখনি পরিচয় হয় ‘মাসিক’ নামের আরেক অধ্যায়ের সাথে।সাধারণত মাসের
চার থেকে সাতদিন পর্যন্ত স্থায়ী হয়। কিশোরী বয়স থেকে শুরু করে প্রায় ৫০ বছর বয়স পর্যন্ত নারীর
দেহে এ প্রক্রিয়া চলতে থাকে। অনেক মেয়েদের ক্ষেত্রে ৯ বছর বয়সেও মাসিক শুরু হয়ে
যেতে পারে। এটি ভয় পাওয়ার বা আতংকিত হওয়ার মতো কিছু নয়। শুরুর দিকে বেশি স্রাব
যাওয়া ও তলপেটে অধিক ব্যাথা হওয়া স্বাভাবিক।আস্তে আস্তে বয়সের সাথে ব্যাথা ও
স্রাবের পরিমাণ স্বাভাবিক হয়ে আসে। মেয়েদের প্রতি ২৪ থেকে ৩২ দিন পর অর্থাৎ গড়ে
প্রায় ২৮ দিন পর পর মাসিক হয়। একে বলা হয় মাসিকচক্র। তবে এ চক্রটি সবার জন্য একি
নাও হতে পারে। কারো জন্য কম বা বেশিও হতে পারে। মাসিক শুরু হওয়ার দিন থেকে শুরু হয়
মাসিকচক্র। মেয়েদের জরায়ু যখন আস্তে আস্তে পরিপক্ক হয়ে উঠে তখন ডিম্বাশয় হতে
ডিম্বানু নির্গত হয় এবং তা ডিম্বনালীতে আসে। একই সময়ে জরায়ুতে রক্তের একটা পাতলা
পর্দা তৈরী হয়। এসময় কোনো পুরুষের সাথে সঙ্গম হলে এবং শুক্রানুর সাথে ডিম্বানু মিলিত
হয়ে ভ্রূণ তৈরী হয়। সেই ভ্রূণ পর্দায় গিয়ে বসে ও ধীরে ধীরে বড় হয়ে পূর্ণাঙ্গ
শিশুতে পরিণত হয়। আর যদি নিষিক্ত না হয় তবে সেই মৃত ডিম্বানুসহ মাসিকের সময় যোনিপথ
দিয়ে বের হয়ে যায়। এটা কোনো শরীরের ভেতরকার আঘাতের কারণে হওয়া রক্তপাত নয়। এটি খুব
স্বাভাবিক একটি শারীরিক প্রক্রিয়া । আর এই প্রক্রিয়ার জন্যই মেয়েদের স্বাভাবিক
বৃদ্ধি হয় ও তার সন্তান ধারনক্ষমতা বৃদ্ধি
পায়। ঋতুচক্র তিন অংশে সম্পন্ন হয়। প্রথমটি চারদিন
স্থায়ী হয় (৪-৭ দিন) এবং একে মিনস্ট্রাল ফেজ বলে। দ্বিতীয়টি ১০ দিন
(৮-১০ দিন) একে প্রলিফারেটিভ ফেজ এবং তৃতীয়টি ১৪ দিন (১০-১৪ দিন) স্থায়ী হয় একে
সেক্রেটরি ফেজ বলা হয়। মেয়েদের মা হওয়ার জন্য মাসিক হওয়াটা অনিবার্য।
মাসিকের সময় যত্নঃ
মাসিকের সময়
রক্তপ্রবাহকে আটকানোর জন্য পরিষ্কার কাপড় বা স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করতে হয়।
এগুলো প্রতি ৫/৬ ঘন্টা অন্তর অন্তর বদলে নিতে হয়। একটানা বেশিক্ষন ব্যবহার করলে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ে। এসময়
পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকা খুব জরুরী। বিশেষ করে যৌনাঙ্গ পরিষ্কার রাখতে হবে। কুসুম
গরম পানি ব্যবহার করলেও কিছুটা স্বস্তি পাওয়া যায়। যদিওবা আদি কাল থেকেই মাসিক এর
সময় কাপড় ব্যবহার করার প্রচলন চলে এসেছে কিন্তু সত্যিকার অর্থে এটি নারীদের শরীরের
জন্য কতটা ক্ষতিকর সেবিষয়ে ইদানীং ডাক্তাররা সতর্ক করে দিচ্ছেন। স্যানিটারি ন্যাপকিন
বা প্যাড ব্যবহার করাই উত্তম। আর প্যাড ব্যবহার করার ক্ষেত্রে যে কয়টি বিশেষ
সচেতনতা অবলম্বন করতে হবে সেগুলো হল-
১) ব্যবহারের আগে
অবশ্যই চেক করে নিন কোনো ধরনের কীট বা ময়লা আছে কিনা প্যাডে।
২) প্যাডের
প্যাকেটে মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ দেখতে ভুলবেন না।
৩) ভালো মানের
তুলার প্যাড ব্যবহার করুন । কিছু প্যাডে জেল থাকে এগুলো ব্যবহার করা উচিত নয়।
৪) প্যাড
ব্যবহারের পর ভালো করে ধুয়ে ডাস্টবিনে ফেলে দিন ।কমোডে ফেলবেন না।
৫) প্রতি ৬ঘন্টা
পর পর প্যাড বদলাতে হবে।
মাসিক চলাকালীন
সময়ে প্রতিদিন গোসল করতে হবে অবশ্যই। পরিষ্কার জামা-কাপড় পরিধান করতে হবে। যদি
প্যাডের পরিবর্তে কাপড় ব্যবহার করেন তবে অবশ্যই তা ভালোভাবে ধুয়ে রোদে শুকাতে দিতে
হবে। আধভেজা কাপড় কখনো ব্যবহার করবেন না।এসময় খাবার খাওয়ার প্রতিও নজর রাখতে হবে।
পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে । বাকি সবকিছুর দিক দিয়েও স্বাভাবিক থাকতে হবে। এসময় রক্ত
প্রবাহিত হওয়ায় শরীরে আয়রণ এর অভাব হয়। তাই প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি সমৃদ্ধ
খাবার যেমন লেবু, কমলা , আমলকি ইত্যাদি খেতে হবে। ভিটামিন সি এর কারণে শরীরে
আয়রণের ঘাটতি কিছুটা পূরণ হয় । এটি আয়রণে শ্বসন ক্ষমতা বাড়ায়। প্রচলিত আছে এসময় টক
জাতীয় খাবার খাওয়া যাবেনা। আমাদের মনে রাখা উচিত যে কোনো খাবারই কখনো মাসিকের সময়
শরীরে প্রভাব ফেলেনা। এ সময় শরীরে পুষ্টিকর খাবারের প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি। মাসিক
চলাকালীন সময়ে কোমরে ও পায়ে ব্যাথা অনুভূত হয়।শরীরে এক বিশেষ ধরনের হরমোনের
উপস্থিতির কারণে জরায়ুর সংকোচন-প্রসারণ ঘটে আর এইজন্য তলপেটে ও কোমরে ভীষণ ব্যাথা
অনুভব হয়। মাসিক চলাকালীন সময়ে মাথাব্যাথা, মাইগ্রেন, ত্বকে নানা সমস্যা,বমিভাব
ইত্যাদি বিভিন্ন রকম শারীরিক সমস্যা লাগতে পারে যা স্বাভাবিক। কারণ এসময় হরমোনজনিত
কারনে এরকম খারাপ লাগা স্বাভাবিক।তাই এসব নিয়ে ভয় পাওয়ার কারণ নেই। তবে যদি ব্যাথা
সহ্য সীমা অতিক্রম করে ফেলে তাহলে ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করুন বা ব্যাথানাশক ঔষধ
খান। এসময় হালকা ব্যায়াম ও গরম সেঁক নিলে কিছুটা আরাম অনুভূত হয়। সবকিছু মিলিয়ে
নিজেকে শারীরিক ও মানসিকভাবে প্রস্তুত রাখতে হবে।
মাসিক নিয়ে
আমাদের সমাজে অনেক প্রতিবন্ধকতা আছে। ছেলেদের কাছে মেয়েদের এই মাসিক ব্যাপারটা
মজার। অনেকেই এটা নিয়ে সরাসরি হাসিঠাট্টা করে। উষ্কানিমূলক কথা বলে। আসলে এটি
পারিবারিক শিক্ষা হওয়া উচিত। পরিবার থেকেই শিখা উচিত কিভাবে মেয়েদের সম্মান করা
উচিত। মেয়েদের এই স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়াকে যাতে তারা সহজভাবে নেয় এবং এই সময়টিতে মেয়ে
সহপাঠী, বোন, মা, স্ত্রী এদের সাহায্য
করে। দৃষ্টিভঙ্গী বদলালেই আমাদের সমাজ ও দেশের উন্নতি অবধারিত। স্কুলে শারীরিক
শিক্ষার অংশ হিসেবে মেয়েদের ঋতুস্রাব নিয়ে ছেলে-মেয়ে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে জানানো
উচিত।