ইভ টিজিং – বর্তমান সময়ের এক আতংকের নাম। দিনের পর দিন যার মাত্রা
বাড়ছে । এটি একটি অপরাধের নাম। এটি মূলত প্রকাশ্যে যৌন হয়রানি, কথায় বা অঙ্গভঙ্গি
দিয়ে নারীদেরকে বিরক্ত করা।
‘ইভ’ শব্দের অর্থ নারী আর
‘টিজিং’ শব্দের অর্থ উত্যক্ত করা। মানে ‘ইভ টিজিং’ অর্থ দাঁড়ায় ‘নারীদের উত্যক্ত
করা’। ব্যাপারটা যতটা সহজ মনে হয় ততটা নয়।
ইভ টিজিং এর শিকার হয়ে অনেকেই আত্মহত্যার মতো পথও বেছে নেয়। ইভ টিজিং বললেই মনের
মধ্যে একটা ছবিই ভেসে উঠে। কিশোরী-তরুনী মেয়েরা স্কুল-কলেজে যাচ্ছে আর তাদের
উদ্দেশ্য করে রাস্তার মোড়্রে বা দোকানে বসে থাকা কিছু যুবক-পুরুষের লোলুপ দৃষ্টি
আর ছুড়ে দেওয়া বাজে কমেন্ট। শুধু স্কুল –কলেজ পড়ুয়া কিশোরী-যুবতী বলে কথা নয়, ইভ
টিজিং এখন এমন ভয়াবহ রুপ ধারন করেছে যে বোরকা পড়া বা পর্দা করে শালীনতার সাথে পথ
চললেও এই নোংরা পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। ইভ
টিজিং নারীদের প্রতি হওয়া এক ধরনের যৌন আগ্রাসন। যৌন ইঙ্গিতবাহী মন্তব্য,
উদ্দেশ্যমূলক গান করা বা টিটকারি দেওয়া, শিস দেওয়া, নানা অঙ্গভঙ্গি করা, শরীরের
বিভিন্ন সংবেদনশীল অংশে হস্তক্ষেপ এগুলো সব ইভ টিজিং এর মধ্যে পড়ে।
ইভ টিজিং শুধু পাড়ার মোড়ে কিংবা রাস্তায় হাঁটার সময়ই হয়না। “মেয়েমানুষ
এর বুদ্ধি কম” এটা দিয়ে ঘর থেকেই ইভ টিজিং এর শুরু। হ্যা, ঠিক। ঘর থেকেই এভাবে
শুরু। কর্মক্ষেত্রে পাশের টেবিলে বসা মেয়ে কলিগের দিকে হেয়ভরে তাকানো বা উদ্দেশ্যমূলক
টিটকারি মারাটাও ইভ টিজিং। লোকাল বাস বা গাড়িতে সিট না থাকার অযুহাতে উঠতে না দেয়া
কিংবা উঠার পর সিট না থাকলে ভালভাবে দাড়াতে না দেয়া, ধাক্কা মারা এগুলো সবই ইভ
টিজিং। নারী – পুরুষ দুজনেই কিন্তু মানুষ। অথচ শক্তি, বুদ্ধি, বল , কাজ করা সবদিক
দিয়েই নারীকে হেয় করা ,উপহাস করা, অবহেলা বা তুচ্ছ করার মত কাজ করা পুরুষরাই এক
একজন ইভ টিজার। একটা মেয়ে যখন ইভ টিজিং এর শিকার হয়ে প্রতিবাদ করে তখনো তার দিকে
আগে আঙ্গুল তোলার মতো মানুষই সমাজে বেশি। ‘তোমার চালচলনের দোষ। পোশাকের দোষ। পর্দা
করোনা বলেই এসব হয়।‘ এইসব উক্তি ঝেড়ে টিজিং টাকে আরো লাস্যময় করে তোলার মতো কাজটাই
বেশিরভাগ মানুষ করে। অথচ ছোট একটা বাচ্চাকে কিংবা বোরকা পড়া কোনো নারীকে যখন
উত্যক্ত করা হয়, বিরক্ত করা হয় তখন কি বলা যায়?পোশাকের দোষ? চলনের দোষ? নাকি
পারিবারিক শিক্ষা আর মূল্যবোধের অভাব?
আমাদের দেশে ইভ টিজিং
রোধে আইন আছে। বাংলাদেশ দন্ডবিধি আইনের ২৯৪
ধারায় বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি
অন্যদের বিরক্তি সৃষ্টি করে, কোনো প্রকাশ্য স্থানের কাছাকাছি কোনো অশ্লীল কাজ করে অথবা
কোনো প্রকাশ্য স্থানে কোনো অশ্লীল গান, গাথা সংগীত বা পদাবলি গায়, আবৃত্তি করে বা উচ্চারণ করে; সেই ব্যক্তি তিন মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ডে বা উভয়
দণ্ডে দণ্ডনীয় হবে। দণ্ডবিধির ৫০৯ ধারায় এ বিষয়ে স্পষ্ট বিধান আছে। এ ধারায় বলা
আছে, যদি কেউ কোনো নারীর
শ্লীলতাহানির উদ্দেশ্যে কথা, অঙ্গভঙ্গি বা কোনো কাজ করে, তাহলে দায়ী ব্যক্তিকে এক বছর পর্যন্ত যেকোনো মেয়াদের সাজা
বা অর্থদণ্ড কিংবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে হবে। এতো আইনী ধারা থাকা স্বত্বেও কিন্তু
আমাদের দেশে ইভ টিজিং এর পরিমান কমেনি।
আমরা সবসময় ভাবি, ইভ
টিজিং কি রুখে দেওয়া যায়না? রুখে দেওয়া যেতো যদি সমাজের সবাই একইভাবে বিষয়টা নিয়ে
ভাবতো। যে মেয়েগুলো ইভ টিজিং এর শিকার হয় তারা নিজেরাই প্রতিবাদ করতে ভয় পায়।
তাদেরকে সাপোর্ট করার জন্য অন্য নারীরা এগিয়ে আসেনা। তারাও সত্যকে ধামাচাপা দেয়ার
পক্ষে থাকে। সমাজ, ঘরের পুরুষ এদের ভয়ে তারাও প্রতিবাদ করেনা। ইভ টিজিং এর
বিরুদ্ধে প্রতিবাদ প্রথমে ঘর থেকেই শুরু করতে হবে। ছেলে-মেয়ে উভয়কেই অন্যায় বুঝতে
শেখান। অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে শেখান। মেয়েকে যেভাবে মার্জিত হতে শিক্ষা দেয়া হয়,
সেভাবে ছেলেকেও সংযত হওয়ার শিক্ষা দিতে হবে। নারী জাতিকে সম্মান করাটা শিক্ষা দিতে
হবে।পরিবারের পাশাপাশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকেও সজাগ হতে হবে। বিশেষ করে প্রথমিক
ও মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তকে এ বিষয়ে সচেতনতার জন্য পাঠ যোগ করা ও
শিক্ষক-শিক্ষিকাদেরও এ বিষয়ে জ্ঞানদান করতে হবে। দেশে আইন তো আছে, সেই আইনের প্রয়োগ
বাড়াতে হবে। সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ নিতে পারলেই এ ধরনের অপরধ অনেকটা কমে আসবে।
সময় বদলাচ্ছে। যুগের সাথে
তাল মিলিয়ে ছেলে-মেয়ে উভয়কেই সমানভাবে এগিয়ে যেতে হবে। পড়ালেখা থেকে শুরু করে
কর্মস্থলে সবখানে নারী-পুরুষ একই সাথে চলছে, চলতে হবে। তাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে
নারী – পুরুষ উভয়কেই মানসিকভাবে নিজেকে
গড়ে তুলতে হবে ।